আগে নিয়মকরে পত্রিকা পড়তাম। সকালে পড়তে না পারলেও রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে দুয়েকটা পত্রিকায় অন্তত নজর বোলাতাম। এখন আর পড়তে ইচ্ছে করে না। পড়লেও খবরের মূল অংশগুলো বাদ দিয়ে কিছুটা অগুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো পড়ি।বরং না পড়তে পারলেই যেন বাঁচি।
কারণ, প্রত্যেকটা দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতার সংবাদ থাকে এখন ধর্ষণের। বাসে ধর্ষণ, পথে ধর্ষণ, বাজারে ধর্ষণ,গ্রামে ধর্ষণ, শহরে ধর্ষণ, হাসপাতালে ধর্ষণ, আদালতে ধর্ষণ, শিক্ষাঙ্গনের ছোট মেয়েটি ধর্ষণ, আড়াই মাসের শিশুটিও ধর্ষণ, শিক্ষক কতৃক ১০ জন ছাত্রী র্ধর্ষিতা, এসব খবর পড়তে আর ভালো লাগে না। দুঃখ করতে করতে দুঃখের জায়গাটা শুকিয়ে গেছে। সংবাদকর্মীদের বহু কষ্টে সাজানো ওইসব খবরগুলো এখন ফিকে মনে হয়। মনে হয় ওগুলো কথার কথা।
মহিলা পরিষদের হিসেব অনুযায়ী মাসে ৭৯ টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে এই দেশে।
পত্রিকাগুলোর হিসেবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে মাসে ৪১ টি, যার মধ্যে ২৯ জনই শিশু।
গত দুইবছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
দিবালোকে শ'খানেক "আবাল" জনতার সামনে যে কেউ, যে কাউকে কুপিয়ে হত্যা করবে, এটাও যেন স্বাভাবিক খবর। নিজের অপরাধকে ঢেকে রাখতে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করবে, এগুলো আমাদের দেশে তেমন কোনো বিষয় নয়। বন্দুকযুদ্ধে হত্যা, দুর্নীতি, জালিয়াতি, খুন-গুম এগুলোর পেছনে নিজেকেও কেন জানি দায়ী মনে হয় আজকাল ।
সরকারি কোনো দপ্তরে ছোট একটা কাজের জন্য দিনের পর দিন হেনস্তা হওয়া, উপায়ান্তর না পেয়ে 'অপরাধের' পথটাকে বেছে নেওয়া এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে আমাদের দেশটাকে নিয়ে যাওয়া এসবের পেছনে নিজেকেই দায়ী মনে হয়।
কারণ, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলি, কালোবাজারি নিয়ে ধোঁয়া তুলি, ধর্ষকের বিচার চাই, সেই আমরাই আবার দিনশেষে রাতে ধর্ষকের পোষাক পরি।
একটি মেয়ে বোরকা পরেও যখন রাস্তায় বখাটে ছেলেদের দ্বারা ইভটিজিংয়ের শিকার হয় তখন ওই বখাটেদের এমন স্পর্ধাকে উপেক্ষা করে, আমরা ওই মেয়েটাকেই গালমন্দ করি । আমাদের সংশয় তৈরি হয়, এমন গভীর রাতে কেমন মেয়েরা বাইরে থাকে! নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছি।
দেশের ভেতর কোনো সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হামলা হলে কোনোরকম বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই সাথে সাথে আমরা তকমা লাগিয়ে দিই বিশেষ একটা শ্রেণীর ওপরে । বলে বেড়াই 'কওমি মাদরাসা জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র'। ঘটনা আর খুঁতিয়ে দেখি না। মিডিয়ার সামনে সন্ত্রাসবাদের আসল খবরগুলো আসতে দেই না। ওদের চেহারায় সার্চলাইটের তীব্র ফোকাস করি না। কারণ, আমি জানি, কেঁচো খুঁড়তে গেলে সাপ বেরিয়ে আসবে।
দেশে ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে । আজকে যে শিশুটির জন্ম হবে, তার মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হবে ৬৭ হাজার ২৩৩ টাকা ঋণের দায়। আমরা কি এগুলোর খবর রাখি?
ক্লাস ফাইভের ছেলেমেয়েদেরকে লেখাপড়া বাদ দিয়ে প্রেম-ভালোবাসা করতে কে শিখিয়েছে?
সম্ভাবনাময়ী যুবকদেরকে মাদকের পথে কে নামিয়েছে?
দেশে এতো মানব-পাচারকারী, এতো ছিনতাইকারীর জন্ম কে দিয়েছে? আমি দিয়েছি। আপনি দিয়েছেন। দেশের নড়বড়ে আইন দিয়েছে।
আমি সুবিধাবাদী, নরম প্রকৃতির মানুষ। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাপুরুষতা। অন্যের ঝামেলায় নিজেকে জড়াই না। জড়াতে চাই না। চোখ-নাক বন্ধ করে 'অল ওকে' ইমেজের ভণ্ড একটা মানুষ আমি।
আমার সামনে ইভটিজিং হয়। চুপ থাকি। কিছু বলি না। আমার সামনে ছেলের বয়সী, ভাইয়ের বয়সী তরুণ খুন হয় । আমি চুপ থাকি। খুন হওয়া ছেলেটার লাল টুকটুকে ভেসে যাওয়া রক্তের স্রোত দেখি।
আমার সামনে আমার বোনের মত, মেয়েরমত একটা কিশোরী ধর্ষিতা হয়। আমি তবুও চুপ থাকি। কিছু বলি না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে হাহাকার করা মেয়েটির সম্ভ্রম হারানোর শোকে আত্মহত্যা করার দৃশ্য দেখি। চুপিসারে একটু চুচু শব্দকরে অতঃপর সেখান থেকে প্রস্থান করি।
কারণ, ভালো বিয়ে ও ভালো চাকরির লোভে আমি লেখাপড়া করেছি। দেশ উদ্ধার করা , দেশের মানুষকে বাঁচানো আমার কাজ নয়।
জানেন, পত্রপত্রিকার হিসেব বলছে, আমাদের দেশে গত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৫৮০টি ধর্ষণের ঘটনায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে শিশু-কিশোর। অনেকে এর জন্য দায়ী করছেন দুর্বল বিচারব্যবস্থাকে। আমি বলব, এই সমাজ এবং জনগণের দায়ও কম নয়। দুর্নীতিবাজ প্রশাসন, বিষাক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, শোষক শ্রেণির বিস্তার, ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড়—এসব এক দিনে হয়নি। এসব আমাদের দুর্বলচিত্তের প্রতিফলন, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে নেওয়ার পরিণাম। শুধু নিজে ভালো থাকতে চাওয়ার প্রতিদান। আমি এই আপস করা শ্রেণির একজন। আমি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ আচরণে বিশ্বাসী।
মসজিদে যখন জান্নাতের নেয়ামতের কথা আলোচনা হয়, তখন আমি খুব খুশি হই, হুজুরকে আলাদা করে বাহবা দিই। প্রশংসা করি। আর যখন সুদ-ঘুষের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়, ধর্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলা হয় , অবিচার -অনিয়ম এবং দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়, তখন আমরা বলি হুজুর মসজিদে অপ্রাসঙ্গিক এবং রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। অন্যায়-অনিয়মের কথা শুধু মসজিদে নয় সবখানেই হতে হবে। নিজেকে কাপুরুষ নয় পুরুষ বানাতে হবে।
প্রতিবাদ আর কেউ করুক বা করুক, আমি করব, এই মানসিকতা পোষণ করতে হবে। কারণ, ত্রিশ লক্ষ শহিদের বিনিময়ে অর্জিত দেশটাকে যেদিকে আমি ঠেলে দিচ্ছি, সে দিকে আমার ভাইবোন, ছেলেমেয়েরাও আছে।
মনে রাখতে হবে, আজকে আমি যদি একজন প্রতিবাদী মানুষ না হতে পারি, তাহলে আমারও একদিন পিঠ ঠেকে যাবে দেয়ালে।
তখন আর কেউ প্রতিবাদী হবে না।
লেখক: সম্পাদক, ইশান
সদস্য: জাতীয় লেখক পরিষদ
2 মন্তব্য
ধন্যবাদ ভাই
উত্তর দিনমুছুনশুকরিয়া
উত্তর দিনমুছুন