মুহাম্মদ বিন ওয়াহিদ : তামাদ্দুন২৪ডটকম: আমাদের মাদরাসার সাথেই ছোট একটা পানের দোকান আছে। সেখান থেকে মাঝেমাঝেই আমি পান কিনি। দোকানের নাম "বাবার পান"। প্রথম যেদিন মাদরাসায় যাই, সেদিনই এই দোকান আমার চোখে পড়ে। কৌতূহল জন্মে দোকানের এমন অদ্ভুত নামের কারণে। যদিও দোকানি বাবা নয়, বরং ছোটো একটা ছেলে। তার নাম নাঈম রহমান। বয়স খুব বেশি হলে ১৫ বা ১৬ হবে। ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালই। কথাও বলে সাজিয়ে গুছিয়ে। সবসময় হাসিখুশি থাকে। তাকে এই দোকানে না দেখলে ধরার উপায় নেই সে যে পানের দোকান করছে।
কয়েকদিন আগে আসরের পরে হাঁটতে বেরিয়েছি। যাচ্ছিলাম নাঈমের দোকানের সামনে দিয়েই। ও তখন দোকানে ছিল না। পাশেই গরম গরম পপকর্ণ বিক্রি হচ্ছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পপকর্ণ খাচ্ছিল। দূর থেকে আমাকে দেখে সালাম দিল। আমি মুচকি হাসি দিয়ে সালামের উত্তর দিলাম। নাঈম আমাকে পপকর্ণ খাওয়ার জন্য ডাকল। আমি বললাম , এখন একটু হাটাহাটি করব, ভাই। পরে কখনও সুযোগ হলে খাব।
একটু পরে আবার পপকর্ণের দোকানে গেলাম। নাঈম তখন ছিল না। দোকানে চলে গেছে।
দোকানদারকে বললাম,ভাই এক প্যাকেট দেন। তিনি দিলেন। আমি পকেট থেকে টাকা বের করলাম দোকানদারকে দেওয়ার জন্য। হঠাৎ দেখি নাঈম কোত্থেকে হাজির হয়ে পপকর্ণওয়ালাকে টাকা দিয়ে দিয়েছে। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। নাঈম পপকর্ণ খাওয়ার জন্য প্রথম যখন ডাকল, তখনই আমার কেনার ইচ্ছে ছিল। কিনলাম না ওর কারণেই। আশংকা ছিল ও এমন করবে। তাই ওর অনুপস্থিতিতে আসা। কিন্তু তাতেও সফল হলাম না।
আসলে নাঈম আমাকে মন থেকেই মোহাব্বত করে। হয়ত সেটা পরস্পরে সালাম বিনিময়ের কারণে। আমি যখনই ওর দোকানে যাই দূর থেকে সালাম দিই। বিষয়টা যেদিন থেকে ও ধরতে পেরেছে, সেদিন থেকে ও সুযোগ পেলে আমার আগেই সালাম দিয়ে ফেলে।
আজকে নাঈমকে নিয়ে একটা হোটেলে গেলাম নাস্তা করার জন্য। কেউ কোনো কিছু হাদিয়া দিলে তাকেও সামান্য কিছু হলেও হাদিয়া দেওয়া যে সুন্নাত, এই সুন্নতকে পালন করার জন্যই মূলত নাঈমকে সঙ্গে এনেছি।
কথা প্রসঙ্গে দোকানের নামকরণের রহস্য জানতে চাইলাম। ও তখন কিছুটা বিষন্ন হয়ে গেল এবং আবেগ ভরা গলা নিয়ে বলল, আমার আব্বু আরও তিনবছর আগে মারা গেছেন। ব্লাডক্যান্সার হয়েছিল তাঁর ।
আব্বু অনেক পরিশ্রম করে একটা গাড়িও কিনে ছিলেন। কিন্তু ক্যান্সার ধরা পড়ার পরে চিকিৎসার জন্য সেটা বিক্রি করতে হয়। তবুও তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তিনি পরপারে ঠিকই চলে গেলেন।
পরিবারে মা,ছয়বছরের ছোট ভাই এবং আমি আছি।
গ্রামে কিছু জমিজমা ছিল, সেগুলো বিক্রি করে মাকে আর ভাইকে নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছি।
কী করব ভেবেচিন্তে ছোট এই দোকানটা ভাড়া নিলাম। যেহেতু আমি ছোট মানুষ;বড় দোকান সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
দোকানের নাম দিলাম, "বাবার পান" ; যেন যখনই আমি দোকানে আসি, তখন "বাবা" শব্দটা দেখে আব্বুর কথা মনে পড়ে। আর তাঁর জন্য দুআ করতে পারি!
আপনি আমার আব্বুর জন্য একটু দুআ করে দিবেন এবং আমার ছোট ভাইয়ের জন্যও। তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। মাকে কোনো কাজ করতে দেই না। আমি বেঁচে থাকতে মা কাজ করবেন কেন?
কথাগুলো শুনে আমার দুই চোখের কোণে পানি জমে গেল। আমার এখন ওকে কী বলা উচিত বুঝতে পারলাম না। ও আমার জন্য সান্তনা, নাকি আমি ওর জন্য সান্তনা, এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম।
আমি মনে মনে শুধু এতোটুকুই বললাম, নাঈমরা কোনো পানের দোকানদার নয়, ওরা মানবতার শিক্ষার দোকান।
লেখক: সম্পাদক-ঈশান
0 মন্তব্য