তামাদ্দুন২৪ডটকম : এফএম প্রজন্ম বলতে তাদেরই বুঝানো হয়ে থাকে যারা বর্তমান সময়ের বিশেষ জনপ্রিয় এফএম রেডিও মাত্রাত্রিরিক্ত শোনেন, মানেন, কার্যত পালন করেন এবং আচরণে ধারণ করেন। এফএম রেডিও গণমাধ্যমের একটি প্রকার। এর শ্রোতা থাকবে এবং শ্রোতারা এ রেডিও চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনবেন, এটি স্বাভাবিক। হচ্ছেও তাই। তবে লক্ষ্যণীয় হলো এফএম এর শ্রোতা সাধারণের প্রায় সর্বাংশই উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী। যার সিংহভাগই নানা পর্যায়ের শিক্ষার্থী, আরও অন্যসব পেশার তরুণ শ্রোতাও ব্যাপক হারে রয়েছে। শ্রমজীবী ছেলেমেয়েদেরও ভীষণ পছন্দের এই রেডিও। অর্থাৎ জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় বয়সের নাগরিকদের কানে এ শ্রবণমাধ্যমটির দখল এখন যারপরনাই বিস্তৃত। এমনকি তারুণ্যের ভুবনে সিনেমা হল, টিভি বা মঞ্চ থেকেও অনেক অনেক বেশি এগিয়ে আছে এই এফএম।
এ অবস্থাটিকে কাজে লাগিয়ে দেশের যুব ও তরুণ শক্তিটিকে একেকটি দেশরত্নে রূপান্তর করা, দেশের আদর্শ নাগরিক ও জাতির উৎকৃষ্ট সদস্য করে গড়ে তোলার বিশাল সুযোগ রয়েছে।
শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, চরিত্র, দায়িত্বশীলতা, সুরুচিবোধ, ধার্মিকতা, দেশপ্রেম, রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক মূল্যবোধ, মানবিকতা, অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য ও উদ্যম ইত্যাদি ইতিবাচক আদর্শিক ও নীতিবান্ধব বিষয়ে জ্ঞান ও উদ্দীপনা প্রদান করে তারুণ্যকে যোগ্যতর আদর্শ নাগরিকরূপে তৈরি করার কাজটি এ এফএম রেডিও মাধ্যমে খুব সহজেই করা সম্ভব। একেবারেই যে হচ্ছে না তা নয়, তবে অত্যন্ত হতাশা ও পরিতাপের বিষয় বর্তমানে বহুল প্রচারিত এফএম চ্যানেলগুলো সাধারণত যেসব অনুষ্ঠান প্রচার করে চলেছে যেসব তারুণ্যের কল্যাণ ও আদর্শ সভ্যতা বিনির্মাণের পথ থেকে বহু যোজন দূরে। যারা এফএম এর ভক্ত নন তবে ওয়াকেফহাল শ্রোতা তারা বিষয়টি অবশ্যই ভালো জানেন এবং বুঝেন। জাতি গঠনের এ অন্যতম সম্ভাবনাময় মাধ্যমটির যথেচ্ছ ভুল ব্যবহার ঘটে চলেছে। এর কোনো বাস্তব প্রতিকার খুব একটা চোখে পড়ছে না। এসব অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে বহুলাংশে বাংলা ভাষার বিকৃত উপস্থাপনা, অসামাজিক ও অনৈতিক চরিত্রের পাঠদান, অসম ও অবৈধ প্রেম পরিণয়ে উৎসাহ প্রদান, নীতিবহির্ভূত ব্যক্তিগত চরিত্র চর্চা, পরোক্ষ এমনকি প্রত্যক্ষ যৌন উস্কানি, বালখিল্যতা ও বাতুলতার অবাধ সংক্রমণ ঘটানো হচ্ছে। এতে করে আমাদের স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি পড়–য়া কোমলমতি তারুণ্য বিপথে উৎসাহিত এবং অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। দেশীয় সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতির আমদানি এবং চাষাবাদের কাজটিও এসব চ্যানেলের মাধ্যমে দেদার চলছে।
উল্লেখ্য, এফএম রেডিওগুলোতে সবচে’ বালখিল্যতাপূর্ণ কুরুচিপূর্ণ ও নীতিবিরুদ্ধ অনুষ্ঠানগুলো মধ্যরাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত প্রচার করা হয়ে থাকে এবং তরুণ-তরুণীরা রাত জেগে এসব গলধঃকরণ করে এবং মোবাইল কল, এসএমএস বা ইন্টারনেটের সাহায্যে নিজেরাও অংশগ্রহণ করে থাকে। বাতুলতা ও নির্লজ্জতায় তারা পারদর্শী হয়ে ওঠতে থাকে। যার প্রভাব তাদের দৈনন্দিন চালচলন, ফ্যাশন ও আচরণে পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
চলায় বলায়, সাজে পোশাকে, আচার ব্যবহারে নিখাঁদ বাঙালিয়ানা যেমন কাউকে বাংলা মাটির সন্তান বলে প্রমাণ করে, তেমনি যখন পথেঘাটে, যানবাহনে বা শিক্ষাঙ্গনে দেখা যাবে কোনো একটি ছেলের মাথার চুল আঠালো বা মুরগির লেজের পুচ্ছের মতো হয়ে আছে, সে খানিকটা কুঁজো হয়ে হাঁটছে, তার পরনের টি-শার্টটি ভিখিরি ভিখিরি লাগছে, প্যান্টটি হাঁটুর নিচু পর্যন্তই শেষ হয়ে গেছে, কোমর থেকে প্রায় যেন খসে পড়ে যাচ্ছে, স্যান্ডেল জোড়া বেশ পুরনো ও এবড়ো থেবড়ো, থুতনির তলদেশে বা চোয়ালে দু’এক চিমটি দাড়ি চরের মতো জেগে আছে, বা তার চোখমুখে ঘুম ঢুলুঢুলু ভাব, এমনকি শুকিয়ে থাকা লালার চিহ্ণ, চোখেও হয়তো ময়লা, সর্বোপরি তার দুটি কর্ণকুহরে দুটি কুলুপ আঁটা, তা থেকে চিকন দুটি তার গলা বেয়ে শার্টের নিচে বা প্যান্টের পকেটে এসে ঢুকে আছে, এবং সে এই সভ্য পৃথিবীকে এবং মনুষ্য জাতিকে অনেকটা ‘কুছ পরওয়া নেহি’ ভাব প্রদর্শন করছে, এবং অবশ্যই তার দিকে প্রথম দৃষ্টি পড়তেই ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফি’ কিংবা ‘অ্যানিমেল’ চ্যানেলের কথা খুব করে মনে পড়ছে তাহলে নিঃসন্দেহে বুঝতে হবে সে একটি এফএম প্রোডাক্ট। সুন্দর করে বলা যেতে পারে সে একজন এফএম সন্তান। মেয়েরাও পিছিয়ে নেই, তবে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে কিছুটা অপ্রকাশিত এই যা। আজকালের দশটি তরুণীর ফোনালাপ অথবা স্বাভাবিক কথোপকথন রেকর্ড করে বাজিয়ে শুনলে বুঝা মুশকিল হবে কথা বলার রঙ, ঢঙ, উচ্চারণ ভঙ্গি, নাকের বাঁশি, ঠোঁটের চটপট, আর খেদ, উষ্মা, রাগ, হাসি ও কাশির মধ্যে এতো বেশি মিল থাকে কী করে!
সব যেনো মেকি, সব যেনো ন্যাকামো, সিনেমা নাটকের অভিনেত্রীরাও এ থেকে মুক্ত নন। দুঃখ এবং আফসোস হয় এ প্রজন্মের জন্য তাদের নৈতিক দৈন্যতা আর আত্মমর্যাদার ঘাটতি দেখে। জোয়ার এলো তো কচুরিপানার মতোই সবাই একদিকে ভেসে চললো। কোথায় তাদের শিক্ষা, কোথায় তাদের সংস্কৃতিবোধ, নীতি-আদর্শ বা ঐতিহ্য। দেশপ্রেমটাকে কেবল পতাকা আঁকা গেঞ্জি বা মাথার ফিতায় আটকে ফেলছে তারা। আপাদমস্তক পশ্চিমা সংস্কৃতিকে ধারণ করে অথবা হৃদয়-মননে ভারতীয় সংস্কৃতি লালন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশকে বোকা বানাচ্ছে। অথচ কোথায় বাংলাদেশ, কোথায় দেশীয় সংস্কৃতি, কোথায় মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তি আর কোথায় আমাদের এফএম প্রজন্ম। অভিভাবকরা না হয় বুঝেন না, বা মন্দটাকেই ভালো বুঝেন অথবা বুঝেও অবুঝ অবাধ্য ছেলেমেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না, শিক্ষক সমাজ তাহলে কী ভূমিকা রাখেন? চোখের সামনে ছাত্রছাত্রীদের বখে যেতে দেখে তারা কেনো নির্লিপ্ত হয়ে থাকেন? তাদের কাজ যদি হয় দেশের ও জাতির সন্তানদের প্রকৃত আদর্শ সভ্য মানুষ করে গড়ে তোলা, তবে জলজ্যান্ত মানুষগুলোকে আস্তে আস্তে অন্য কিছু হয়ে যেতে দেখেও তারা কী করে তা মেনে নেন, বুঝা দুষ্কর।
এ ব্যাপারে সরকারেরই বা ভূমিকা কী? এফএম রেডিওগুলোর বাংলা ভাষা বিকৃতি রোধে উচ্চ আদালতের একটি নিষেধাজ্ঞা এলেও তা কতোটা কার্যকর হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। আর এ ভাষা বিকৃতি ছাড়াও শ্রোতাদের রুচি বিকৃতি, চিন্তা-চেতনা বিকৃতি, সভ্যতা ও শালীনতা বিকৃতি এবং রাত জেগে শারীরিক ও মানসিক বিকৃতিরও প্রতিকার সরকার কর্তৃক বা উচ্চ আদালত কর্তৃক হওয়া দরকার। এবং এর বাস্তব প্রয়োগও দরকার।
যুব সমাজের শিক্ষা ও চরিত্র ধ্বংসের এই কারখানায় কী কী উৎপাদন ও বিতরণ করা হচ্ছে দায়িত্বশীলদের এ ব্যাপারে জ্ঞাত ও তৎপর হওয়া দরকার।
অন্যথায় এ ক্ষতির জের শত বছর দেশ ও জাতিকে বয়ে বেড়াতে হবে। এই তুমুল জনপ্রিয় এফএম এর সঠিক ও উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণ যুব সমাজের সর্বোচ্চ কল্যাণ এবং উপকারের ব্যবস্থাও হাতে নিতে হবে। বিপুল সম্ভাবনাময় জাতির ভবিষ্যত এই তারুণ্যকে সময়ের এ রাহুগ্রাস থেকে বাঁচাতে হবে। এফএম প্রযুক্তির এই যাবতীয় মন্দ ব্যবহারকে কল্যাণকর ব্যবহারে পাল্টে নিতে হবে। এটি এখন সবার গুরুদায়িত্ব। দেশ গড়ার কাজে, সভ্য আদর্শ ও উন্নত জাতি গঠনের প্রয়োজনে প্রযুক্তি এবং তারুণ্যের শক্তি দুটিই অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ দুয়ের ভুল ব্যবহার দেশ ও জাতির আগামীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর এ দুইয়ের সঠিক ব্যবহার দেশ ও জাতিকে পৃথিবীর সামনে এনে দিতে পারে বিরল সম্মান ও সাফল্য। আমাদেরকে এ সম্মান ও সাফল্যের পথ ধরেই এগোবার পথ খুঁজে বের করতে হবে সময় ফুরাবার আগেই।
লেখক: কবি, গীতিকার, সুরকার, রাষ্ট্র চিন্তাবিদ ও দার্শনিক।
0 মন্তব্য